Website Logo

শুধু কাট নয়, গল্প”: ভিডিও এডিটিং টুলে স্টোরিটেলিং

ভিডিও এডিটিংয়ের দুনিয়ায় জনপ্রিয় কিছু সফটওয়্যার

আজকের ডিজিটাল বিশ্বে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। আপনি যদি একজন ভিডিও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে থাকেন তা সে ইউটিউবার হোন, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, অনলাইন টিচার কিংবা একজন ডিজিটাল মার্কেটারই হোন না কেন, আপনাকে ভিডিও এডিটিং এবং এর সফটওয়্যার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার। একটি আকর্ষণীয় এবং প্রফেশনাল ভিডিও তৈরির জন্য শুধুমাত্র ভালো ক্যামেরা বা সুন্দর স্ক্রিপ্টই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন হয় সঠিক এডিটিংয়ের। 

ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার সম্পর্কে কতটুকু জানি? 

প্রফেশনাল ভিডিও এডিটর ব্যতীত ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার সম্পর্কে খুব কম মানুষই বিস্তারিত জানেন। কিন্তু ভিডিও এডিটিং সম্পর্কে আমরা সাধারণত সবাই কমবেশি জানি যে, একটি ভিডিও ফাইলকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ভিডিও ক্লিপ, মিউজিক, ছবি ও শব্দগুলোকে একসাথে যুক্ত করে নতুন রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া, যা সঠিকভাবে আমাদের অনুভূতিগুলো একটি ভিডিওর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে। অর্থাৎ, একটি ভিডিও ক্লিপকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়াই হলো ভিডিও এডিটিং। আর এই ভিডিওকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য, ভিডিওগুলোকে একত্রিত করা এবং ম্যানিপুলেট করার জন্য যে মাধ্যম বা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয়, তাকেই ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার বলে। যেমন - DaVinci Resolve, Adobe Premiere Pro, OpenShot, Filmora এমন আরও অনেক সফটওয়্যার।  

ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের কাজ কী?

কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে এদের কাজ সাধারণত একই ধরনের। এডিটিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কাজগুলো করা যায় - 

  • কাট, ট্রিম ও স্প্লিট (Cut, Trim & Split):  অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেওয়া, ভিডিওর লেন্থ (দৈর্ঘ্য) কমানো বা বড় কোনো ক্লিপকে ছোট ছোট ক্লিপে ভাগ করা। 

  • ক্লিপগুলোকে একত্রিত করা (Merging Clips):  একাধিক ভিডিও ক্লিপকে একটি টাইমলাইনে নিয়ে এসে যুক্ত করা, যাতে একটি ধারাবাহিক গল্প তৈরি হয়। 

  • ট্রানজিশন যোগ করা (Adding Transitions):  এক ক্লিপ থেকে অন্য ক্লিপে স্মুথভাবে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্রানজিশন (যেমন - ফেড, ডিসলভ, ওয়াইপ) ব্যবহার করা।

  • অডিও এডিটিং (Audio Editing):  ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যোগ করা, ভয়েসওভার রেকর্ড করা, শব্দের লেভেল কন্ট্রোল, নয়েজ কমানো এবং অডিও ইফেক্ট যোগ করা।

  • ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট ও ফিল্টার (Visual Effects & Filters):  ভিডিওকে আরও আকর্ষণীয় করতে কালার কারেকশন, ফিল্টার, গ্রাফিক্স, টেক্সট ওভারলে এবং বিভিন্ন ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট যোগ করা।

  • টেক্সট ও টাইটেল (Text & Titles):  ভিডিওতে টাইটেল, সাবটাইটেল এবং অন্যান্য টেক্সট ইনফরমেশন যোগ করা।

  • মোশন গ্রাফিক্স (Motion Graphics):  অ্যানিমেটেড টেক্সট, লোগো বা গ্রাফিক্যাল উপাদান যোগ করা।

  • মাল্টিট্র্যাক এডিটিং (Multitrack Editing):  একই সময়ে একাধিক ভিডিও এবং অডিও ট্র্যাক নিয়ে কাজ করা, যা জটিল প্রজেক্টের জন্য অপরিহার্য।

  • এক্সপোর্ট ও শেয়ার (Export & Share): সম্পাদিত ভিডিওটিকে বিভিন্ন ফরম্যাটে (যেমন MP4, MOV) রেন্ডার করা এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে (যেমন YouTube, Facebook) সরাসরি শেয়ার করার সুবিধা দেওয়া।

কিন্তু প্রশ্ন হলো — বাজারে শত শত ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের মধ্যে কোন ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারটি আপনার জন্য সবচেয়ে উপযোগী? কোনটিই বা বেছে নেবেন? কোনটি আপনার দক্ষতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত? এই আর্টিকেলে আমরা জনপ্রিয় কিছু ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। যেগুলো ব্যবহার করে আপনি প্রফেশনাল লেভেলের ভিডিও তৈরি করতে পারবেন, চাহিদা অনুযায়ী ফিচার বেছে নিতে পারবেন এবং শেখার ধাপগুলোতে সহায়তা পাবেন। 

বিগিনার লেভেল ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার

১. CapCut :  CapCut বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রি ভিডিও এডিটিং অ্যাপ। ByteDance কোম্পানির তৈরি এই সফটওয়্যারটি মোবাইল এবং ডেস্কটপ দুটি ভার্সনেই পাওয়া যায়। মোবাইল-ফার্স্ট ইন্টারফেস, শর্ট ভিডিও এডিটিংয়ে উপযোগী। সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, টিকটক এবং রিলস তৈরি করতে, এবং যারা মোবাইল বা ডেস্কটপে দ্রুত এবং ট্রেন্ডি ভিডিও তৈরি করতে চান তাদের জন্য বেস্ট অ্যাপ।

অটোমেটিক সাবটাইটেল তৈরি এবং ভয়েস জেনারেট করার সুবিধা রয়েছে। ক্রিয়েটিভ এডিটিংয়ের জন্য বিভিন্ন এআই ফিচার আছে। খুব সহজেই ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ করা, রয়্যালটি-মুক্ত সাউন্ডট্র্যাক এবং সাউন্ড ইফেক্ট এড করা যায়। এটি লং প্রজেক্টের জন্য প্রযোজ্য নয়। 

২. Filmora:  Wondershare Filmora তার সহজবোধ্য ইন্টারফেস এবং অসংখ্য ক্রিয়েটিভ টুলের জন্য জনপ্রিয়। বিগিনার এবং ইন্টারমিডিয়েট ব্যবহারকারীদের জন্য একটি চমৎকার সফটওয়্যার। এটি উইন্ডোজ, ম্যাকওএস, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএসের জন্য পাওয়া যায়। 

ফিলমোরা মূলত একটি এআই-চালিত ভিডিও এডিটর এবং মুভি মেকার, যেখানে টেক্সট টু ভিডিও, এআই অটো কাট, এআই রিমুভার, এআই ভয়েস ক্লোনিং, ডায়নামিক ক্যাপশন, টেক্সট টু স্পিচ ইত্যাদি ফিচার রয়েছে। টিউটোরিয়াল এবং গেমিং ভিডিও তৈরির জন্য স্ক্রিন ক্যাপচার করার সুবিধাও রয়েছে। ভারী কিছু প্রজেক্টে এর পারফরম্যান্স কিছুটা ধীর হতে পারে।

৩. InShot:  মোবাইল ভিডিও এডিটিং এর জন্য InShot একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অ্যাপ। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট তৈরির জন্য এটি খুবই কার্যকর। স্লো-মো টাইপের ছোট ভিডিও তৈরির জন্য উপযুক্ত। এটি MP4, MOV, AVI, FLV, 3GP প্রভৃতির মত বেশিরভাগ ভিডিও ফরম্যাট এক্সেপ্ট করে। জটিল প্রজেক্টের জন্য উপযুক্ত নয়। এডিটিং এর পরে ওয়াটার মার্ক থাকে যা পেইড ভার্সনে থাকে না। 



ইন্টারমিডিয়েট লেভেল ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার

১. Adobe Premiere Pro (অ্যাডোবি প্রিমিয়ার প্রো)

প্রফেশনাল ভিডিও এডিটর, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ইউটিউবার, এবং এজেন্সি যারা হাই কনফিগারেশন এবং জটিল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য অ্যাডোবি প্রিমিয়ার প্রো বেস্ট একটি অ্যাপ্লিকেশন। Adobe Premiere Pro ভিডিও এডিটিং শিল্পের একটি মানদণ্ড। এটি অ্যাডোবি ক্রিয়েটিভ ক্লাউডের একটি অংশ, যা এটিকে Adobe After Effects (ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট), Adobe Photoshop (ইমেজ এডিটিং), এবং Adobe Audition (অডিও এডিটিং) এর মতো অন্যান্য অ্যাডোবি অ্যাপ্লিকেশনের সাথে নির্বিঘ্নে কাজ করার ক্ষমতা দেয়। প্রিমিয়ার প্রো তার শক্তিশালী টুলসেট, নমনীয় ইন্টারফেস এবং উন্নত কাজের জন্য পরিচিত। 

একাধিক ভিডিও এবং অডিও ট্র্যাক একসাথে এডিট করার সুবিধা এবং Lumetri Color প্যানেলের মাধ্যমে বিস্তারিত কালার কারেকশন এবং গ্রেডিংয়ের ক্ষমতা রয়েছে। নয়েজ রিডাকশন, অডিও মিক্সিং এবং সিনক্রোনাইজেশনের জন্য শক্তিশালী একটি টুল। আপনার কাজের ধরন অনুযায়ী ওয়ার্কস্পেস কাস্টমাইজ করার সুবিধা। প্রায় সব ধরনের ভিডিও, অডিও এবং ইমেজ ফরম্যাট সমর্থন করে।

২. DaVinci Resolve (ডাভিঞ্চি রিজলভ):

কালার গ্রেডিং বিশেষজ্ঞ, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ভিডিওগ্রাফার, এবং যারা প্রফেশনাল লেভেলের ভিডিও এডিটিং টুলস বিনামূল্যে পেতে চান তাদের জন্য এই সফটওয়্যার উপযুক্ত। Blackmagic Design দ্বারা তৈরি DaVinci Resolve পূর্বে শুধুমাত্র একটি কালার গ্রেডিং সফটওয়্যার হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটিশক্তিশালী ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার, যা নন-লিনিয়ার ভিডিও এডিটিং, কালার কারেকশন, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, এবং অডিও পোস্ট-প্রোডাকশনের জন্য পরিচিত। এটি ম্যাক, উইন্ডোজ ও লিনাক্স - এই তিনটি অপারেটিং সিস্টেমের জন্য প্রযোজ্য। 

হলিউড লেভেলের কালার কারেকশন এবং গ্রেডিং ক্ষমতা অসাধারণ। এডিটিং থেকে শুরু করে VFX এবং অডিও পর্যন্ত এটি একটি একক ওয়ার্কফ্লো। এমনকি স্টুডিও ভার্সনে একই প্রজেক্টে একাধিক এডিটরের একসাথে কাজ করার সুবিধা রয়েছে। এর রিসোর্স বেশ ভারী হওয়ায় এর জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার প্রয়োজন।

৩. Final Cut Pro X (Apple)

Final Cut Pro ( সংক্ষেপে FCP বা FCPX ) সাধারণত ম্যাক ইউজাররা, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, এবং দ্রুত ও দক্ষ এডিটিং প্রয়োজন এমন প্রফেশনালরা ব্যবহার করে থাকে। এটি শুধুমাত্র ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমের জন্য প্রযোজ্য। এটি তার উদ্ভাবনী ‘ম্যাগনেটিক টাইমলাইন’, ৩৬০° ভিডিও এডিটিং, দ্রুত রেন্ডারিং এবং Apple ইকোসিস্টেমের সাথে নিবিড় ইন্টিগ্রেশনের জন্য সুপরিচিত। এটি বিশেষ করে যারা ম্যাক কম্পিউটারে দ্রুত এবং প্রফেশনাল কাজ করতে চান, তাদের জন্য আদর্শ।  

অ্যাডভান্সড লেভেল ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার

১. Avid Media Composer

হলিউড এবং টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য Avid Media Composer একটি স্ট্যান্ডার্ড সফটওয়্যার। বড় বাজেটের ফিল্ম এবং টিভি শো তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। নন-লিনিয়ার এডিটিং, অ্যাডভান্সড মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, হাই-রেজোলিউশন সাপোর্ট, নেটওয়ার্ক স্টোরেজ, স্ক্রিপ্ট ইন্টিগ্রেশনের ক্ষেত্রে এই সফটওয়্যার কার্যকরী। তবে, এটি অত্যন্ত জটিল এবং খরচ বেশি। 

২.  Adobe After Effects

ভিডিও কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের এই যুগে, শুধুমাত্র ভালো এডিটিংই যথেষ্ট নয়, ভিডিওকে আরও আকর্ষণীয় এবং প্রফেশনাল করতে প্রয়োজন হয় ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস (VFX) এবং মোশন গ্রাফিক্সের ম্যাজিক। আর এই জন্য বিশ্বজুড়ে পেশাদারদের অন্যতম পছন্দের সফটওয়্যার হলো Adobe After Effects (অ্যাডোবি আফটার ইফেক্টস)। এটি শুধু একটি ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী কম্পোজিটিং অ্যাপ্লিকেশন। এটি অ্যাডোবি ক্রিয়েটিভ ক্লাউডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার ফলে এটি Premiere Pro, Photoshop, Illustrator, Audition সহ অন্যান্য অ্যাডোবি অ্যাপ্লিকেশনের সাথে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে।  

কিভাবে সঠিক ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার নির্বাচন করবেন?

নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করুন: 

বিষয়

বিবরণ

উদ্দেশ্য

আপনি কিসের জন্য এডিট করছেন – YouTube, প্রজেক্ট, ফিল্ম, অফিস?

ডিভাইস

উইন্ডোজ, ম্যাক, মোবাইল – আপনার ডিভাইস কী সাপোর্ট করে?

দক্ষতা

আপনি কি বিগিনার, ইন্টারমিডিয়েট নাকি প্রফেশনাল এডিটর?

বাজেট

আপনি ফ্রি ব্যবহার করতে চান, নাকি প্রিমিয়াম ফিচার প্রয়োজন?

শেখার সুযোগ

সফটওয়্যারটির টিউটোরিয়াল, কমিউনিটি বা কোর্স সহজলভ্য কিনা?

প্রতিটি ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এগুলোর কার্যকারিতা নির্ভর করে আপনার প্রয়োজন ও দক্ষতার উপর। মনে রাখবেন, সফটওয়্যারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার ক্রিয়েটিভিটিএবং স্টোরিটেলিং এর দক্ষতা। যেকোনো সফটওয়্যার দিয়েই চমৎকার ভিডিও তৈরি করা সম্ভব, শুধু প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান এবং নিয়মিত অনুশীলন। 


chat

স্বত্ব © 2025 আইসিটিবাংলা. কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

Trade licence Number TRAD/DNCC/002367/2024